Magic Lanthon

               

মাহামুদ সেতু

প্রকাশিত ২৩ মার্চ ২০২৪ ১২:০০ মিনিট

অন্যকে জানাতে পারেন:

 বলিউডের সেই সব চলচ্চিত্র

‘দেশপ্রেম’-এর আড়ালে নগ্ন জাতীয়তাবাদ

মাহামুদ সেতু


সম্প্রতি বিশ্ব হিন্দু পরিষদের আন্তর্জাতিক মহাসচিব চম্পত রাই ভারতের হিন্দুদেরকে চারটি করে সন্তান নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। কারণ, তা না হলে ২০৫০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ নাকি ভারত ভূখণ্ড থাকলেও ‘হিন্দুস্তানের’ অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়বে। যুক্তরাষ্ট্রের পিও রিসার্চ সেন্টার তাদের এক প্রতিবেদনে প্রকাশ করেছে, ২০৫০ খ্রিস্টাব্দে ইন্দোনেশিয়াকে পিছনে ফেলে ভারতে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি মুসলমান বাস করবে। এতে করে স্বভাবতই হিন্দুস্তানের মর্যাদা লুণ্ঠিত হবে। সেই ভয়েই চম্পত রাইয়েরা বলেন, ‘একটি সন্তানে দেশ রক্ষা হবে না। এজন্য চার সন্তানের জন্ম দিতে হবে।’

আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, ২৫ বছর আগেও মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঠিক একই ধরনের প্রচার চালানো হয়েছিলো ভারতে। ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দের দিকে ‘হিন্দু ভাইরা ভাবো ও সাবধান হও’ শিরোনামের সেই প্রচারপত্রে হিন্দুদেরকে ১৯টি প্রশ্ন করা হয়। এই প্রশ্নগুলোর মূল কথা ছিলো মুসলমানরা সংখ্যায় বেড়ে যাচ্ছে। এমনটি চলতে থাকলে ১২-১৫ বছরের মধ্যে তারা ভারতের শাসন ক্ষমতা দখল করে নিবে। তাই সময় থাকতে হিন্দুদেরকে সংখ্যাগরিষ্ঠতা বজায় রাখতে পদক্ষেপ নিতে হবে। এটা করার জন্য দুইটি উপায় রয়েছে। হয় মুসলমান কমাতে হবে, নয়তো হিন্দু বাড়াতে হবে।

পাঠক, ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দের ভারত আর ২০১৫’র ভারত যে এক নয়, তা সে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক বা সামাজিক যে ক্ষেত্রেই হোক না কেনো, সেটা তো সবাই জানে। ৯০ পরবর্তী সময়ে অর্থনীতিতে উদারনীতি গ্রহণের কারণেই বিশ্ব অর্থনীতিতে ভারত আজ উদীয়মান পরাশক্তি। আর পুঁজিবাদের এই স্ফুরণ বিশ্ব রাজনীতিতে ভারতকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। মূলত ‘... পুঁজিবাদ আর গণতন্ত্র সমার্থক। পুঁজিবাদের অগ্রগতি গণতন্ত্র প্রসারের পূর্বশর্ত।’ তাইতো সোয়াশো কোটি মানুষের ভারত বর্তমানে নিজেকে বিশ্বের সবচেয়ে বড়ো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে পরিচয় দেয়। পাশাপাশি সামাজিক দিক থেকেও যে ভারত অনেক ‘এগিয়েছে’, সম্প্রতি লিভ টুগেদারকে বিয়ের মর্যাদা দেওয়ার মাধ্যমে তারই প্রমাণ পাওয়া যায়। তাহলে ২৫ বছরের ব্যবধানে সামাজিক, রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক দিক থেকে যে ‘উদার’ ভারত-রাষ্ট্র আমরা দেখি, তার সঙ্গে তো উপরের মুসলমান বিরোধী প্রচার মিলে না। ২৯টি রাজ্য নিয়ে গঠিত বহুজাতিভিত্তিক ভারত-রাষ্ট্রে মুসলমানরা শুধু ভিন্ন একটি জাতি মাত্র। তাহলে মুসলমানদের সঙ্গে হিন্দুদের সঙ্কট কোথায়? তাছাড়া গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে তো সবাই সমান, ভারতের সংবিধানও সে কথাই বলে¾প্রজাতন্ত্রের সব প্রজাই (নাগরিক) সমান। কিন্তু আইন আর তার চর্চা বা প্রয়োগ তো ভিন্ন কথা বলে!

আসলে সমস্যা হলো, হিন্দুদের বিশ্বাস¾ ‘ভারতের মুসলিমরা পাকিস্তানি’। তার মানে, যে দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারতের জন্ম, সেই তত্ত্ব অনুযায়ী মুসলমানরা ভারতীয় হওয়ার যোগ্যতা হারিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে জাতীয়তা হচ্ছে সাংস্কৃতিক পরিচয়। সেদিক থেকে তো ভারত-রাষ্ট্রে হিন্দু, মুসলমান, শিখ, বিহারি, বাঙালি, পাঞ্জাবি নির্বিশেষে সবাই ভারতীয় হিসেবে পরিচয় দেওয়ার কথা। কিন্তু দ্বি-জাতি তত্ত্বের ফেরে পড়ে জাতীয়তাবাদ এখানে সাম্প্রদায়িকতায় রূপান্তর হয়েছে। যে জন্যই ‘আমরা সবাই এক’ এই ডাকে সাড়া দিয়ে একটি জাতি গঠন হলেও, এখানে এই ‘আমরা’ কারা তা নিয়ে সঙ্কট রয়েছে। ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের ফসল বাংলাদেশে যেমন বাঙালি জাতীয়তা রয়েছে, তেমনই বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদও রয়েছে। একইভাবে সাম্প্রদায়িক চেতনার ভিত্তিতে জন্ম নেওয়া ভারতেও তাই ভারতীয় জাতীয়তাবাদ ও হিন্দু জাতীয়তাবাদ আলাদাভাবে দৃশ্যমান হয়। যার চরম রূপ দেখা যায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায়।

আর রাষ্ট্রই আবার এই দাঙ্গাফ্যাসাদকে জিইয়ে রাখে। কারণ, দাঙ্গাফ্যাসাদ, অন্যায় না থাকলে তো খোদ রাষ্ট্রেরই প্রয়োজন ফুরায়! তাই রাষ্ট্রের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য প্রয়োজন পড়ে জাতীয়তার নামে মানুষকে এক ছাতার নীচে নিয়ে আসার। এজন্যই মানুষের মাথায় হাত বুলিয়ে দেশপ্রেমের বীজ বপন করা হয়, যাতে তারা নিজে থেকেই রাষ্ট্রের অন্যায়-অত্যাচার সহ্য করার পরও ‘নিজের দেশ’¾এই মন্ত্র ধারণ করে রাষ্ট্রদ্রোহী না হয়। অন্যদিকে রাষ্ট্র তার নাগরিকদের সবসময় ‘জুজু’র (বহিঃশত্রু, যদিও তৃতীয় বিশ্বে বিষয়টি এতো প্রকট নয়) ভয় দেখিয়ে ‘খোঁয়াড়ে’ তুলে রাখে। পুঁজিবাদী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে করপোরেট গণমাধ্যমও এ কাজে সবসময় রাষ্ট্রকে যথাসাধ্য সহায়তা দিয়েছে। আদতে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভটিকে তো পুঁজিবাদীরাই নিয়ন্ত্রণ করে, তাই রাষ্ট্রের গুণ তো গণমাধ্যমকে গাইতেই হয়।

অন্যদিকে সমাজতন্ত্রে গণমাধ্যম সরাসরি রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণেই থাকে। ফলে তার কাজই হয় জনগণকে এটা বোঝানো¾‘আমরা’ই ঠিক, ‘আমরা’ই সেরা। আর গণমাধ্যমের অন্যতম পুঁজিঘন শাখা চলচ্চিত্রও এ কাজে যথেষ্ট পটু। তাইতো ইরাক কিংবা আফগানিস্তানে আমেরিকান সৈন্যরা কীভাবে মানবতার সেবা করছে সে নিয়ে যতো চলচ্চিত্র নির্মাণ হয়, সেখানে তাদের দ্বারা যেভাবে মানবতা লঙ্ঘিত হচ্ছে তা নিয়ে তার এক অংশও হয় না। আর চলচ্চিত্রসহ অন্যান্য মাধ্যমে এই চর্চাই আমেরিকাকে সাংস্কৃতিকভাবে বিশ্ব-মোড়ল হিসেবে টিকিয়ে রাখে।

চলচ্চিত্রে জাতীয়তাবাদের এই চর্চা নতুন কিছু নয়। পার্থক্য কেবল তার ধরন, উপস্থাপন ও উদ্দেশ্যে। জাতীয়তাবাদের একেবারে অন্যরকম এক উপস্থাপন পাওয়া যায় বলিউডের অনেক চলচ্চিত্রে। যেখানে আঞ্চলিক স্বার্থগত রাজনীতি জাতীয়তাবাদের নগ্ন রূপ নিয়ে হাজির হয়। যদিও সেসব নগ্নতা দেশপ্রেমের চাদরে ঢাকা থাকে। সেটা করা হয় চলচ্চিত্রে ভারত-রাষ্ট্রকে অন্য রাষ্ট্রের চেয়ে বিশাল, ক্ষমতাবান, উদার ও সফল হিসেবে তুলে ধরে। সম্প্রতি সাড়া জাগানো হায়দার (২০১৪), ব্যবসায়িকভাবে সফল ভাগ মিলখা ভাগ (২০১৩) এবং ভিন্ন ধারার ফিল্মিস্তান-এ (২০১২) উঠে আসা ভারতীয় জাতীয়তাবাদের স্বরূপ উদ্ঘাটনের প্রচেষ্টা এই প্রবন্ধটি।

তিনটি চলচ্চিত্র প্রসঙ্গ

নির্মাতা বিশাল ভরদ্বাজ শেক্সপিয়রের ‘‘হ্যামলেট’কে কাশ্মির প্রেক্ষাপটে উপস্থাপন করেছেন হায়দার-এ। পারিবারিক ট্র্যাজেডির মধ্য দিয়ে তুলে এনেছেন ভারতের কাশ্মির ইস্যু¾কাশ্মিরের ‘জঙ্গি’ ও রাষ্ট্রীয় বাহিনীর মধ্যকার সংঘাতকে। সেখানে জঙ্গিদের চিকিৎসা করায় নিজের ভাইকে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর কাছে ধরিয়ে দেয় খুররম। আর হায়দার পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নিতে চাচার ওপর চড়াও হয়েও শেষ পর্যন্ত তাকে ছেড়ে দেয়। এর মধ্য দিয়ে হায়দার শেষ হয় ঠিকই, তবে কাশ্মিরের অস্থিরতা শেষ হয় না। সেই অস্থিরতা শেষ হতে ভারতীয় সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ লাগে।

৪৭-এর দেশভাগের দাঙ্গায় পাকিস্তান থেকে পালিয়ে আসা শিখ মিলখা সিং-এর সফল ভারতীয় হয়ে ওঠার গল্প ভাগ মিলখা ভাগ। সাধারণ কোনো ভারতীয় হন না মিলখা, দৌড়বিদ হিসেবে বিশ্বমঞ্চে ভারতের প্রতিনিধি হয়ে ওঠেন। কিন্তু তিনি পাকিস্তানের মুসলিম-শিখ দাঙ্গার ভয়াবহ স্মৃতি ভুলতে পারেন না। চলচ্চিত্রের শুরুতেই দেখানো হয়, দাঙ্গার ভয়াবহ স্মৃতি মনে পড়ে যাওয়ায় অলিম্পিকে জিততে জিততে হেরে যান তিনি। শেষমেষ সেই পাকিস্তানে গিয়ে পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত মিলখার ‘ভারতীয়’ হিসেবে সম্মান আদায় করার মধ্য দিয়েই চলচ্চিত্রটি শেষ হয়।

চলচ্চিত্র তারকা হওয়ার স্বপ্নে বিভোর সানিকে পেট চালাতে সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করতে হয়। সেই সূত্রে একবার এক আমেরিকান প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতার সঙ্গে কাজ করতে রাজস্থানে যেতে হয় তাকে। পথিমধ্যে ‘‘জঙ্গি’’রা আমেরিকান মনে করে সানিকে অপহরণ করে পাকিস্তানে নিয়ে গিয়ে সীমান্তবর্তী একটি গ্রামে আটকে রাখে। যে বাড়িতে তাকে আটকে রাখা হয় সে বাড়ির বড়ো ছেলে আফতাব আবার ভারত থেকে চলচ্চিত্রের পাইরেটেড ডিভিডি নিয়ে এসে নিজ এলাকায় বিক্রি করে। শিল্প-সাহিত্যে ভারতের অগ্রগতি নিয়ে উচ্ছ্বাস, বিপরীতে পাকিস্তানের অধোগতি নিয়ে ক্ষোভ ঝরে পড়ে আফতাবের কণ্ঠে। শেষে সানির সঙ্গে সেও ‘‘ব্যর্থ’ পাকিস্তান ছেড়ে ‘সফল’’ ভারতে চলে আসে। এই হলো ফিল্মিস্তান

চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে হায়দারভাগ মিলখা ভাগ বক্স অফিসে ব্যবসাসফল। ফিল্মিস্তান ২০১২’’র এবং ভাগ মিলখা ভাগ ২০১৩’’র জাতীয় পুরস্কার বিজয়ী। তাছাড়া হায়দারও ২০১৪-তে সংলাপ ও সঙ্গীত শাখায় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে ভূষিত হয়।

জাতীয় চলচ্চিত্র বনাম জাতীয়তাবাদী চলচ্চিত্র এবং ...

নির্মাতা তার কল্পনার ইমেজগুলোকে সেলুলয়েডের ফিতায় একের পর এক সাজিয়ে রুপালি পর্দায় প্রক্ষেপণ করলে, দর্শকের কাছে সেটা জীবন্ত হয়ে ধরা দেয়। ইমেজ ধারণ করার মাধ্যম হিসেবে এখন আর সেলুলয়েড নেই, তবে জীবন্ত গল্প¾চলচ্চিত্র কিন্তু আছে। চলচ্চিত্রে বাস্তবের নির্মাণও সমানতালে চলছে। কিন্তু চলচ্চিত্রের এই বাস্তবটা কী? ‘আসলে [চলচ্চিত্রের] ইমেজ হচ্ছে বাস্তবতার ফাংশনাল এক্সপ্রেশন বা অভিব্যক্তি। যখনই একটি ইমেজ নির্মিত [হয়] হচ্ছে তখন তা সরাসরি একটি দেশ-কালের প্রতিনিধিত্ব [করে] করছে।’ অর্থাৎ, চলচ্চিত্রটি ভিন্ন পরিচয়, ভিন্ন দেশের জাতীয়তা লাভ করে; সেই রাষ্ট্রের জাতীয় বিশ্বাস ও চেতনাকে ধারণ করে। তবে যেহেতু চলচ্চিত্রকে বলা হয় ডিরেক্টরস্ মিডিয়াম, সেহেতু কর্তা-নির্মাতার চেতনার পরিস্ফুটন সেখানে পাওয়া যায়। নির্মাতার জাতীয় চেতনার রিপ্রেজেন্টেশন ঘটে।

কিন্তু চলচ্চিত্রের কি জাতীয় পরিচয় থাকতেই হবে কিংবা জাতীয় হতেই হবে? নাকি নির্মাতা না চাইলেও কোনো না কোনোভাবে চলচ্চিত্র একটা জাতীয় চরিত্র রিপ্রেজেন্ট করে? আদতে বাস্তবতার নিরিখে যে চলচ্চিত্রই নির্মাণ হোক না কেনো, সেখানে জাতীয় পরিচয় উঠে আসেই; কারণ ‘‘এইসব ছবি দেশ কালহীন, সিনথেটিক এবং প্রেডিক্টেবল মানবতার ইমেজ নয়।’ তবে নির্মাতা ভেদে পার্থক্য কেবল জাতীয়তার উপস্থাপনায়।

আইজেনস্টাইন ও পুদভকিনের চলচ্চিত্রে যেখানে জনগোষ্ঠীর বাস্তবতা-বিশ্বাস বিভিন্ন আঙ্গিকে উঠে আসে, সেখানে তারকোভস্কি রুশ জাতীয় চলচ্চিত্রে ব্যক্তি মানুষের বোঝাপড়ার মাত্রা তুলে ধরেছেন। অর্থাৎ ভিন্ন পথে চললেও তাদের চলচ্চিত্রগুলো রুশ জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলো না। আবার সত্যজিৎ মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করলেও ঋত্বিকের চলচ্চিত্রে উঠে আসে ভারতের অন্তর্জাত সত্তা। দেখা যাচ্ছে নির্মাতা ভেদে চলচ্চিত্রের বিষয়বস্তু আলাদা হলেও স্বাভাবিকভাবেই তাদের চলচ্চিত্রগুলো জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক, জাতীয় হয়ে উঠেছে।

কিন্তু সমস্যা হয় তখনই, যখন নির্মাতা তার চলচ্চিত্রটিকে জাতীয় করে তোলেন। কারণ চলচ্চিত্রের এই জাতীয় রূপটি একপর্যায়ে জাতীয়তায় রূপ নেয়; আর জাতীয়তার সর্বোচ্চ রূপ কখনো কখনো সহিংস, সাম্প্রদায়িক হয়ে ধরা দেয়। ১৯৪৯-এ ভারতে এসে জ্যঁ রেঁনোয়া যখন দ্য রিভার (১৯৫১) নির্মাণ করেন সেটা কিন্তু ভারতীয় নয়, ভারতীয় গল্পের হলিউডি চলচ্চিত্রই হয়ে ওঠে। কারণ এখানে যে ভারত দেখানো হলো তা ফরাসি-রেঁনোয়ার উপনিবেশিক চোখে দেখা ভারত। ভারত সম্পর্কে তার চিন্তা-চেতনার রিপ্রেজেন্টেশনই দ্য রিভার; যেখানে ‘‘রেঁনোয়া উচ্চস্থান বরাদ্দ রেখেছেন ব্রিটিশদের জন্যই!’ যেটা আগেই বলেছিলাম, নির্মাতার জাতীয় সংস্কৃতিই চলচ্চিত্রে পরিস্ফুটিত হলো। কর্তা-নির্মাতা তার চলচ্চিত্রকে জাতীয় করে তুলতে গিয়ে সাম্প্রদায়িক হয়ে পড়েন। নিজ জাতি-রাষ্ট্রের জয়গানের বিপরীতে ‘‘অসভ্য’, ‘‘বর্বর’’ ভারতকে তুলে ধরেন। এসব ক্ষেত্রে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর হলো, জাতীয়তাবাদের সহিংস রূপটি চলচ্চিত্রে প্রকট হয়ে ওঠে। জাতীয়তাবাদী চেতনার বদৌলতে শুধু ভিন্ন মত, ধর্ম, রঙের কারণেই একে অপরের ওপর খড়গহস্ত হয় নিজ জাতিকে জেতানোর জন্য। আর চলচ্চিত্রে নিজ জাতির বিজয় দেখে মানুষ আত্মিক প্রশান্তি লাভ করে, গর্ব বোধ করে। রাষ্ট্র সুযোগ পায় সাংস্কৃতিক আধিপত্য কায়েমের, যেটা আবার রাজনৈতিক আধিপত্যকে শক্তিশালী করে।

হলিউডের চলচ্চিত্রে ইরাক বা আফগানিস্তানে বোমা নিষ্ক্রিয় করে আমেরিকার সেনাদের মানবতার সেবা দেখানো হয়। বিপরীতে তারা যে ‘মুসলিম জঙ্গি’ নিধনের নামে বাছবিচার ছাড়াই হাজার হাজার মানুষ হত্যা করে সে নিয়ে টু কথাটিও থাকে না। চলচ্চিত্রে একের পর এক যুক্তি তুলে ধরে যুদ্ধের ন্যায্যতা ও বৈধতা আদায় করে নেয় আমেরিকা। কারণ ‘তারা বেশ ভালো করেই জানে, সম্মতি আদায়ের মাধ্যমে কোনোকিছু দখলে রাখতে পারাই হলো সেসবের পুরোটা ইচ্ছেমতো ভোগের অধিকার আদায় করা।’ আর এভাবে ভোগে সহায়তার পুরস্কার হিসেবে অস্কার তুলে দেওয়া হয় দ্য হার্ট লকার-এর (২০০৮) হাতে।

কিন্তু এর বিপরীত চিত্রও রয়েছে। রাষ্ট্রের জাতীয়তাবাদী চেতনার সঙ্গে তাল মিলিয়ে হলিউডের চলচ্চিত্র যেখানে অস্কার পায়, সেখানে রাষ্ট্রের সেই জাতীয় চরিত্রের বিরুদ্ধে কথা বলার কারণে ইরানের জাফর পানাহিকে কারাবরণ করতে হয়। সামাজিকভাবে নারীর যে অধস্তনতা, তার বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলায়, রাষ্ট্রের স্বৈরাচারী নিয়মের বিরোধিতা করায় ক্ষমতাসীনদের রোষানলে পড়েন তিনি। তার পরও ন্যায়নীতি বিসর্জন দিয়ে রাষ্ট্রীয়-জাতীয়তার কাছে মাথা নত করেননি তিনি।

‘‘দেশপ্রেম ইমানের অঙ্গ’

রাষ্ট্র তার নাগরিকের কাছে একান্ত আনুগত্য কামনা করে; বিপরীতে সে প্রতিশ্রুতি দেয় নাগরিকের সর্বাঙ্গীন মঙ্গলের। জনগণের মৌলিক চাহিদা পূরণের দায়িত্ব নেয় সে। দৃশ্যত বৈষম্যহীনভাবে নাগরিকদের সেবা করার অঙ্গীকারও করে। কিন্তু বাস্তবে রাষ্ট্র এর ঠিক উল্টোটাই করে! কারণ বৈষম্য, সন্ত্রাস, সহিংসতাকে জিইয়ে রাখার মাধ্যমে রাষ্ট্র তার নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখে। এ এক অদ্ভুত খেলা। আর এই খেলার পুরোটা জুড়ে আছে পুঁজি এবং রাষ্ট্রকাঠামোতে সেই পুঁজির ব্যবহার। তাইতো বিশ্বের সবচেয়ে ‘ভালো’’ গণতন্ত্র ও সবচেয়ে বড়ো ধনতন্ত্রের দেশেও ‘‘অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট’ আন্দোলন হয়, স্লোগান ওঠে ‘‘উই আর দ্য নাইন্টি নাইন পারসেন্ট’। রাষ্ট্রভেদে শাসনের ধরন বদলালেও শোষণ বদলায় না। কিন্তু এতকিছুর পরও জনসাধারণ এই শোষণ মেনে নেয়!

পুঁজিবাদী রাষ্ট্র আদর্শিক ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে মানুষের মধ্যে মিথ্যাচৈতন্য১০ নির্মাণ করে। যে মিথ্যাচৈতন্য মানুষকে তার সক্ষমতা, তার অধিকারের ব্যাপারে সচেতন হতে দেয় না। বিপরীতে শোষণকে ভাগ্য হিসেবে মেনে নেওয়ার আহ্বান জানায়। মানুষ আশা করে, রাষ্ট্র একদিন না একদিন তার জীবনে কল্যাণ আনবেই। এই প্রত্যাশায় তারা রাষ্ট্রের প্রতি একান্ত অনুগত থাকে। এই আনুগত্য এমন পর্যায়ে যায় যে, তারা সেই শোষক রাষ্ট্রের জন্য কখনো কখনো জীবন দিতেও পিছপা হয় না। পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় শোষণ-বঞ্চনার শিকার হওয়ার পরও এর বিরুদ্ধে কথা বলতে পারে না।

মানুষ জন্ম থেকেই নিশ্চয়ই দেশপ্রেমী হয় না। বরং তার মধ্যে ধীরে ধীরে এই চেতনা গড়ে উঠতে থাকে। ধর্ম, বিদ্যালয়, গণমাধ্যমের মতো সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো অন্য অনেক কিছুর সঙ্গে সারাক্ষণ কোনো না কোনোভাবে এই আমজনতার মধ্যে দেশপ্রেমের ধারণায়নের চর্চা চালাতে থাকে। রাষ্ট্র মাত্রই কল্যাণকর¾এই চিন্তার প্রাথমিক রূপ হিসেবে তারা হাজির করে দেশপ্রেম নামের হাতিয়ার। কিন্তু মানুষে মানুষে বৈষম্য আর দূর হয় না। বরং মুক্তবাজারের নামে নিম্নবর্গকে উচ্চবর্গের সঙ্গে অসম প্রতিযোগিতায় ফেলে দেয়। ফলে বছর বছর জি ডি পি বাড়লেও দারিদ্র কমে না। নয় শতাংশ জি ডি পি’র দেশ ভারতের এক-তৃতীয়াংশ মানুষ এখনো দারিদ্রসীমার নীচে বাস করে।১১ তাছাড়া শিক্ষা-স্বাস্থ্যর মতো মৌলিক চাহিদা পূরণেও ভারত অনেক পিছনে।

দেশটির ৮৫ শতাংশ গ্রামে কোনো মাধ্যমিক বিদ্যালয় নেই। শুধু তা-ই না, মাত্র ১০ শতাংশ শিক্ষার্থী কলেজ পর্যায়ে শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পায় ভারতে। অন্যদিকে স্বাস্থ্যখাতে মোট জি ডি পি’র মাত্র এক শতাংশ ব্যয় হয়।১২ বিপরীতে প্রতিরক্ষায় ব্যয় হয় এর দ্বিগুণেরও বেশি।১৩ তাহলে যে রাষ্ট্র নাগরিক সেবার পরিবর্তে ‘‘লাঠিয়াল’ পোষায় বেশি মনোযোগী, সেই রাষ্ট্রের প্রতি মানুষ কেনো অনুগত থাকবে? রাষ্ট্র এটা জানে দেখেই নাগরিককে দেশপ্রেমে ভোলায়, রাষ্ট্র-চেতনাকে ধারণ করতে শেখায়। আর লাঠিয়ালের প্রয়োজনীয়তা বোঝানো বা রাষ্ট্রের ‘সফলতা’র সুরা পান করিয়ে মানুষকে অচেতন করে রাখতে গণমাধ্যম ও এর অন্যতম শাখা চলচ্চিত্র তো রয়েছেই। ভাগ মিলখা ভাগ-এ বস্তি থেকে উঠে আসা মিলখা যখন পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে ‘উড়ন্ত শিখ’’ খেতাব পান, তখন সাধারণ ভারতীয়রা নিশ্চয়ই তা দেখে গর্বিত হয়। অন্যদিকে সেই সব বস্তিবাসীরা স্বপ্ন দেখে আরো একজন মিলখা হওয়ার, যে মিলখা একসময় প্রাণ বাঁচাতে পাকিস্তান থেকে ভারতে পালিয়ে এসেছিলেন। আর ভারত-রাষ্ট্রের বদান্যতাতেই তো উদ্বাস্তু মিলখা ‘‘উড়ন্ত শিখ’ হতে পারেন। নিজের জন্মভূমি হলেও মিলখা ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পাকিস্তান যেতে চান না। প্রধানমন্ত্রী নেহরু তাকে ডেকে পাঠালে সেখানে তিনি বলেন¾

মিলখা : স্যার, আমি পারবো না। আমার পা উঠবে না। পাকিস্তানের বাতাসে আমার পরিবারের লোকের রক্ত মিশে আছে। সেখানে আমি শ্বাস নিতে পারবো না।

নেহরু : দেখো বাবা, তুমি একজন সৈনিক; তোমাকে এখন দেশের দরকার। এজন্য যদি তোমাকে নিজের সঙ্গেও লড়তে হয়, তাও করতে হবে।

এরপর দেশপ্রেমের টানে, দেশের সম্মান রক্ষা করতেই মিলখা পাকিস্তান যেতে রাজি হন এবং সেখানে গিয়ে ভারতকে বিজয়ও এনে দেন। প্রমাণ হয়, পাকিস্তান যে প্রতিভাকে ধরে রাখতে পারেনি, গৃহহারা করেছে¾ভারত সেই মিলখার যথার্থ মূল্যায়ন করেছে, নিরাপত্তা দিয়েছে। পাকিস্তানের ফেলে দেওয়া ‘‘পাথর’কে সোনায় পরিণত করেছে ভারত-রাষ্ট্র। জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে নিজ রাষ্ট্রকে শ্রেষ্ঠ হিসেবে ভালোই উপস্থাপন করলেন নির্মাতা রাকেশ ওমপ্রকাশ মেহরা।

আবার ফিল্মিস্তান-এ জঙ্গিরা যখন ভারতীয় চলচ্চিত্র দেখিয়ে সমাজে ‘‘নোংরামি’ সৃষ্টির জন্য পাকিস্তানি আফতাবকে দোষারোপ করে, তখন সে পাল্টা জবাব দেয়¾

আমাদের এখানে কোন ভালো চলচ্চিত্র হচ্ছে? ‘‘আমার ভেজা চুল, ভেজা ব্লাউজ; ছোকরা আমার ঘরে আয়’¾তা ছোকরারা ঘরে এসে তো আর তসবি পড়বে না! সেজন্যই ভাইজান, আমি চাই আমাদের ললিউডেও [লাহোরভিত্তিক চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রি] বলিউডের মতো ভালো ভালো চলচ্চিত্র হোক। আর এই বলিউডওয়ালারা আমাদের চলচ্চিত্র পাইরেসি করুক। মাঝে মাঝে মনে হয়, ক্যামেরা নিয়ে মাঠে নেমে পড়ি। আমিও জানি দর্শক কী চায়, কী চায় না।

এই বক্তব্যে ললিউডের দুরবস্থার কথা যেমন এসেছে, তেমনই বলিউডকেও সফল বলিয়ে নেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে শিল্প-সাহিত্যের বিকাশে পাকিস্তান যেমন ব্যর্থ, ঠিক তেমনিভাবে আফতাবদের মতো চলচ্চিত্রপ্রেমীদের সুযোগ দানেও রাষ্ট্রটি ব্যর্থ। নির্মাতা মনে হয় ভারতের বিপরীতে পাকিস্তানকে ব্যর্থ প্রমাণে বদ্ধপরিকর! অবশ্য জাতীয়তাবাদ তো এটাই।

অন্যদিকে হায়দার-এর শেষে হঠাৎ প্রোলঙ ভেসে ওঠে¾

IN THE LAST TWO DECADES, THOUSANDS OF LIVES HAVE BEEN LOST IN THE KASHMIR CONFLICT. THE LAST FEW YEARS OF RELATIVE PEACE HAVE RENEWED HOPE. WITH TOURISM GROWING FROM JUST 4.2 MILLION TOURISTS IN 1995 T0 140 MILLION TOURISTS IN 2013. IN THE RECENT DEVASTATING FLOODS IN KASHMIR, THE INDIAN ARMY SAVED THE LIVES OF THOUSANDS OF CIVILIANS. WE SALUTE THEIR EFFORTS AND THEIR VALOUR. PRINCIPAL PHOTOGRAPHY FOR THIS FILM WAS ENTIRELY CONDUCTED IN KASHMIR WITHOUT ANY DISRUPTION.

অর্থাৎ, গত দুই দশকে কাশ্মির যুদ্ধে হাজার হাজার লোক প্রাণ হারিয়েছে। তবে গত কয়েক বছরের শান্তি প্রক্রিয়া আশা জাগানিয়া। ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দে কাশ্মিরে মাত্র ৪২ লক্ষ পর্যটক আসলেও, ২০১৩-তে এসেছে ১৪ কোটি। সম্প্রতি কাশ্মিরের ভয়াবহ বন্যায় সেনাবাহিনী হাজার হাজার মানুষের প্রাণ বাঁচিয়েছে। আমরা তাদের এই কাজকে স্যালুট জানাই। কোনো প্রকার বাধা ছাড়াই এই চলচ্চিত্রের মূল দৃশ্য ধারণ করা হয়েছে কাশ্মিরে।

প্রোলঙের শেষ লাইন থেকে শুরু করা যাক। যেখানে বলা হচ্ছে, কোনো প্রকার বাধা ছাড়াই চলচ্চিত্রটির (হায়দার) দৃশ্য ধারণ করা হয়েছে কাশ্মিরে। তার মানে, একসময় সেখানে বাধা ছিলো। তো এই বাধার কারণ কী; এই বাধার অবসান হলোইবা কীভাবে? কিংবা কারা বাধা দিতো? পুরো চলচ্চিত্রে এ প্রশ্নগুলোকে এড়িয়ে শেষ করা হয়েছে কেবল কাশ্মিরের সর্বশেষ অবস্থা জানিয়ে। আবার গত দুই দশকে কাশ্মিরে হাজার হাজার মানুষ যুদ্ধে মারা গেছে বলা হলেও, এই যুদ্ধ ঠিক থেমে গেলো কীভাবে¾তারও উত্তর পাওয়া যায় না। এছাড়া শান্তি প্রক্রিয়া নিয়ে নির্মাতা আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন; বলেছেন বন্যায় সেনাবাহিনীর সেবামূলক কাজের কথাও। তার মানে কাশ্মির সংক্রান্ত যাবতীয় কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে ভূমিকা রেখেছে ভারতীয় সেনারা। তাই নির্মাতা তাদের গর্ব ভরে স্যালুটও জানান।

তার এই স্বীকারোক্তিতে এটা বুঝতে কষ্ট হয় না যে, যতো শান্তির কথাই বলা হোক না কেনো, কাশ্মিরের এই শান্তি আসলে সেনা নিয়ন্ত্রিত একটি বিশেষ পরিস্থিতি। আর মহান সেই সেনারা ভারতের। যারা তাদের সবটুকু দেশপ্রেম নিয়ে হাজির থেকেছে কাশ্মিরে। আর এই স্বীকারোক্তির মধ্য দিয়ে ঢাকা পড়ে যায় সেনাবাহিনীর হাতে প্রতি ছয় জন কাশ্মিরির মধ্যে একজন নির্যাতিত কিংবা আট হাজার কাশ্মিরি নাগরিক গুম হওয়ার ঘটনা। একই সঙ্গে রাষ্ট্র/সেনা বৈধতা পায় কাশ্মিরে লাশের স্তূপ করার। কারণ, এই লাশ তখন আর কাশ্মিরি জনগণের থাকে না, হয় ‘পাকিস্তানি দালালের’! আর ‘‘দেশপ্রেমিক’’ জনতাও দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের জন্য ‘‘হুমকি’ এসব মানুষের মৃত্যুকে ন্যায্য হিসেবে মেনে নেয়। শেষ পর্যন্ত দেশপ্রেমের ঘাড়ে চেপে জয় হয় জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রেরই।

তবে এই বিজয়ী রাষ্ট্রের এতো ‘‘শান্তি’র মধ্যে থেকেও কাশ্মিরের অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থীকে দেখা যায় ২০১৪-তে এশিয়া কাপ ক্রিকেটে ভারত-পাকিস্তান ম্যাচে পাকিস্তানকে সমর্থন করতে। যে দোষে এই শিক্ষার্থীরা আবার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃতও হন।১৪ একই ভারতের নাগরিক হওয়ার পরও কেবল ইসলাম ধর্মের অনুসারী বলেই কি পাকিস্তানকে সমর্থন করেন তারা? নাকি রাষ্ট্রীয় নিপীড়নে অতিষ্ঠ হয়ে তারা ভারত বিদ্বেষী হয়ে ওঠেন?

প্রতিপক্ষ কেবলই পাকিস্তান!

যে তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত উপমহাদেশকে ভাগ করা হয়েছিলো সেই তত্ত্বটিই ছিলো দ্বান্দ্বিক, যার ফলে ৬৭ বছর পরও ভারত-পাকিস্তান বন্ধুপ্রতিম হতে পারেনি। ৪৭, ৬৫, ৭১ ও সর্বশেষ ৯৯-এ দেশ দুটি সামরিক লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়। এর মধ্যে ৭১-এ বাংলাদেশের স্বাধীনতা নিয়ে এবং বাকিগুলো কাশ্মিরের দখল নিয়ে। যাই হোক, এখন সামরিক লড়াই না চললেও দেশ দুটির মধ্যে শীতল অবস্থা কিন্তু কাটেনি। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক সবদিক থেকেই বর্তমানে ভারত-পাকিস্তান যোজন যোজন দূরে অবস্থান করলেও সামরিক, সাংস্কৃতিক প্রতিটি ক্ষেত্রেই আপাত একধরনের প্রতিযোগিতা এখনো বিদ্যমান। সেই প্রতিযোগিতার ধারাবাহিকতায় এই তিনটি চলচ্চিত্রেও প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে ভারতের রাষ্ট্রীয় প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে পাকিস্তানকে উপস্থিত করা হয়েছে।

ভাগ মিলখা ভাগ-এ দাঙ্গায় মিলখার পরিবারের লোকদের হত্যা করে পাকিস্তানি মুসলিমরা। চলচ্চিত্রের তিন মিনিট ২০ সেকেন্ড থেকে শুরু করে শেষ পর্যন্ত পাঁচ বার এই হত্যার দৃশ্যটি দেখানো হয়। অন্যদিকে ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দে এশিয়ান গেমসের তৃতীয় আসরে মিলখার প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখানো হয় পাকিস্তানি আব্দুল খালিককে এবং শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানে গিয়ে খালিককে হারানোর মধ্য দিয়ে চলচ্চিত্রটি শেষ হয়। এ পর্যায়ে বাস্তবে খেলার মাঠে কী হয়েছিলো তা একটু জানা দরকার। এশিয়ান গেমসের ওই আসরে দুইশো মিটার স্প্রিন্টে মিলখার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পাকিস্তানি খালিক দ্বিতীয় হন, যেটা চলচ্চিত্রে দেখানোও হয়েছে। কিন্তু চারশো মিটারেও মিলখা সোনা জিতেন ফিলিপাইনের পাব্লো সমব্লিঙ্গোকে হারিয়ে, যেটা আর দেখানো হয়নি।১৫ আর এই দেখানো বা না-দেখানো যে উদ্দেশ্যমূলক তা বোঝা যায় পাকিস্তানি খালিক একশো মিটারে সোনা জেতার পর খালিক ও তার কোচকে মিলখা ও তার কোচ শুভেচ্ছা জানাতে যাওয়ার দৃশ্যে। সেখানে মিলখাকে তার কোচ চারশো মিটারে ভারতের জাতীয় চ্যাম্পিয়ন এবং খালিকের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিলে পাকিস্তানি কোচ বলেন, ‘‘হ্যাঁ খালিক, মিলখার কাছ থেকে সাবধান। শুনেছি সে (মিলখা) ছোটোবেলায় পাকিস্তান ছেড়ে দৌড়ে পালিয়েছিলো। তার পর থেকে সে দৌড়েই যাচ্ছে। ... এ রকম মিলখা-টিলখা বহু দেখেছি।’

যাহোক, এশিয়ান গেমসের ওই আসরে শুধু দুইশো মিটারে মিলখার চ্যাম্পিয়ন হওয়া দেখানো হলো, কিন্তু চারশো মিটারের দৌড় নিয়ে কোনো কিছুই দেখানো হলো না। তাহলে চারশো মিটারে পাকিস্তান অনুপস্থিত বলেই কি চলচ্চিত্রেও সেটা অনুপস্থিত?

অন্যদিকে ফিল্মিস্তান-এ সানির অপহরণকারীরা পাকিস্তানি মুসলিম জঙ্গি। তারা সানিকে ধরে নিয়ে গিয়ে পাকিস্তানেই আটকে রাখে। পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী গ্রামের বাসিন্দারা বাধ্য হয়ে জঙ্গিদের আশ্রয়ও দেয়। আবার হায়দার-এ কাশ্মিরের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনে জঙ্গিদের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে পাকিস্তান উপস্থিত। সেখানে জঙ্গিদের অন্যতম নেতা রুহ্কে পাকিস্তানি আই এস আই এজেন্ট হিসেবে পরিচয় দেওয়া হয়। আর রুহ্ যদি আই এস আই এজেন্ট হয়, তবে হায়দারের বাবা চিকিৎসক হিলাল মিরও পরোক্ষভাবে একই দোষে দুষ্ট হন। যদিও হিলাল জঙ্গিদের চিকিৎসা করাকে তার নৈতিক দায়িত্ব মনে করেন। তার মতে, রোগীর কোনো ধর্ম-বর্ণ, দোষ-গুণ থাকে না। তাই তার স্ত্রী যখন তাকে জিজ্ঞেস করেন, ‘‘তুমি কোন পক্ষে?’ তিনি উত্তর দেন, ‘‘আমি জীবনের পক্ষে।’ কিন্তু রাষ্ট্র এটা মানবে কেনো? যে জঙ্গিগোষ্ঠীর এক সদস্যের চিকিৎসা হিলাল করেন, তাদের হাতেই বেশ কয়েকজন ভারতীয় সেনা নিহত হতে দেখা যায় পরের দৃশ্যে। আর এদের আশ্রয় দেওয়ায় হিলালও পরোক্ষভাবে দোষী প্রমাণিত হন। সঙ্গে বোমা মেরে তার বাড়ি উড়িয়ে দেওয়ার বিষয়টিও বৈধতা পায়।

তাছাড়া পরে সেই জঙ্গিগোষ্ঠীর সঙ্গেই রুহ্কে দেখা যায়। এমনকি কারাগারে রুহ্ ও হায়দারের বাবা একই প্রকোষ্ঠে বন্দি ছিলেন। দুজনের প্রতি আচরণ দেখে তাদের সমমানের অপরাধী বলে মনে হয়েছে। মানে কাশ্মিরের বিচ্ছিন্নতাবাদীরা সবাই পাকিস্তানের মদদপুষ্ট! কবরস্থানের গোরখোদক থেকে শুরু করে চিকিৎসক পর্যন্ত সবাইকে পাকিস্তানের এজেন্ট হিসেবে উপস্থিত করা হয়, তাই কাশ্মিরের অস্থিরতার মূল কারণ হয়ে দাঁড়ায় পাকিস্তান, রাষ্ট্র হিসেবে ভারতের কোনো দায় থাকে না।

মোদ্দা কথা হলিউডের চলচ্চিত্রে যেমন ‘‘জুজু’র (মুসলিম জঙ্গি) ভয় দেখিয়ে নাগরিকদের নিরাপত্তার নামে রাষ্ট্রীয় অত্যাচার মুখ বুজে সহ্য করতে বাধ্য করা হয়, তেমনই এই চলচ্চিত্রগুলোও নিশ্চয়ই বহিঃশত্রুর ভয় দেখিয়ে ভারতীয়দের এক ছাতার নীচে আনতে চায়। কিন্তু পাকিস্তান কিংবা মুসলমানরাই যদি ভারতের একমাত্র শত্রু হয়, তাহলে ‘‘ভারতের ৪০ শতাংশ এলাকা জুড়ে যে মাওবাদীরা তৎপরতা চালাচ্ছে’১৬ তারা কারা? এরাও কি মুসলিম, কিংবা পাকিস্তানের আশীর্বাদপুষ্ট? ভারতের এ ধরনের অন্যান্য অভ্যন্তরীণ সমস্যাও তো কম নয়। মাওবাদী-নকশালবাদীরা ভারতীয় হয়েও ভারতের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরে, সরকার তাদের সবচেয়ে বড়ো অভ্যন্তরীণ হুমকি হিসেবে গণ্য করে, উলফা বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন চালাচ্ছে। এ রকমের নিরাপত্তাজনিত সমস্যা ছাড়াও সামাজিক সমস্যাও রয়েছে। এদেশে ধনী-গরিবের মধ্যে অর্থনৈতিক দূরত্ব আকাশ-পাতাল, প্রতিবছর হাজার হাজার কৃষক আত্মহত্যা করে। শিক্ষার সুষম ও পর্যাপ্ত সুযোগ নেই, ৮৫ শতাংশ গ্রামে মাধ্যমিক বিদ্যালয় না থাকা কিংবা মাত্র ১০ শতাংশের কলেজ পর্যায়ে শিক্ষা লাভ সেটাই প্রমাণ করে। তাহলে এতো সমস্যার পরও পাকিস্তান বা মুসলমানকে ভারতের একমাত্র শত্রু হিসেবে উপস্থাপন করার উদ্দেশ্য কী? পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের করপোরেট গণমাধ্যম কি এক শত্রু দেখিয়ে বাকি সমস্যাগুলোকে আড়াল রাখতে চায়? নাকি নিম্নবর্গের ইনসাফ আদায়ের লড়াইকে গোপনে দমন করতে চায়, যে জন্য জনগণের দৃষ্টিকে অন্যদিকে ঘুরিয়ে রাখতে এই আয়োজন?

জঙ্গি ভয়ঙ্কর!

ফিল্মিস্তান-এ বন্দি সানি এক জঙ্গির সঙ্গে বাজি ধরে ভারত-পাকিস্তান ক্রিকেট ম্যাচ নিয়ে। কথা হয় পাকিস্তান জিতলে সানি জঙ্গিদের সব কথা মেনে নিবে, বিপরীতে ভারত জিতলে ছেড়ে দেওয়া হবে তাকে। টানটান উত্তেজনায় খেলা চলতে থাকে। শেষ পর্যন্ত জিতে যায় ভারত। কিন্তু সানির আর বাড়ি ফেরা হয় না। উল্টো পাকিস্তানের মাটিতে দাঁড়িয়ে ভারতের জয় উদ্যাপন করায় সানির প্রতি সহিংস হয়ে ওঠে ওই জঙ্গি। এখানেই শেষ নয়। চলচ্চিত্রটির শেষ পর্যায়ে জঙ্গিদের নেতা কথা দেন সানিকে ছেড়ে দেওয়ার। কথা মতো আফতাব ও সানিকে সীমান্তবর্তী এলাকাতে নিয়েও যাওয়া হয়। কিন্তু ছেড়ে দেওয়ার বদলে তাদেরকে হত্যা করতে উদ্যত হয় আগের সেই জঙ্গি। যদিও অপর এক জঙ্গি তাকে হত্যা করে সানি ও আফতাবকে বাঁচিয়ে দেয়। বোঝা যায়, জঙ্গি হলেও তার মধ্যে মনুষ্যত্ব আছে। কিন্তু ওদেরকে বাঁচিয়ে দিলেও সে নিজে বাঁচতে পারে না। জঙ্গি নেতা আবার এই জঙ্গিকে খুন করেন। প্রতিষ্ঠিত হয়, মনুষ্যত্ব থাকলে জঙ্গি হওয়া যায় না, মৃত্যুবরণ করতে হয়।

অপরদিকে সানিকে মারধর ও হত্যা করতে উদ্যত হওয়ার ঘটনা দুটির মধ্য দিয়ে যা হয়, তাতে জঙ্গিদের নৈতিক অবস্থান বলে আর কিছু থাকে না। যে জঙ্গিরা ইসলামের তাওহীদ প্রতিষ্ঠার কথা বলে তাকওয়া ভিত্তিক জীবন যাপন করে, তারাই যে মুনাফিকের মতো আচরণ করে তা প্রতিষ্ঠিত হয়। আর মুনাফিকের পক্ষে সবকিছুই সম্ভব। ফলে চলচ্চিত্রের এই উপস্থাপনের বদৌলতে জঙ্গিরা যেমন প্রশ্নবিদ্ধ হয়, তেমনই যে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করার কথা তারা বলে, সেই ইসলামও প্রশ্নবিদ্ধ হয়। একই সঙ্গে এটাও প্রমাণ হয়, জঙ্গিরা বিরুদ্ধ কোনো মতকে গ্রহণ করতে জানে না।

প্রকৃতপক্ষে একসময় যোদ্ধা অর্থে জঙ্গি শব্দটা ব্যবহৃত হতো। ৯/১১’র পর নতুন বিশ্ব পরিস্থিতিতে জঙ্গির নতুন অর্থ দাঁড়িয়েছে সন্ত্রাসী-ধর্মান্ধ-নিষ্ঠুর হত্যাকারী। আর তাদের এ ধরনের হত্যা বা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের পিছনে ধর্ম প্রতিষ্ঠার মতো সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য থাকে।১৭ কিন্তু হায়দার বা ফিল্মিস্তান-এ জঙ্গিদের এ ধরনের কোনো আদর্শিক অবস্থান চোখে পড়ে না। সেখানে বার বার জঙ্গি কথাটা আসলেও কারা আসলে ‘জঙ্গি’, কেনো কেউ ‘‘জঙ্গি’’ হয়, তাদের উদ্দেশ্য কী¾এসব নিয়ে কিছুই বলা হয়নি। কেবল একে-৪৭ হাতে দাড়ি-টুপিওয়ালাদের দেখানো হয়েছে!

হায়দার-এ বার বার রাষ্ট্রীয় বাহিনীর বয়ানে জঙ্গিরা কীভাবে নিরপরাধ মানুষ মারছে, পাকিস্তানের সহায়তায় কীভাবে দেশের স্থিতিশীলতা নষ্ট করছে তা শোনানো হয়। সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ এক কর্মকর্তা জঙ্গি দমনে নতুন ইউনিট গঠনের সময় বলেন, ‘‘পুনর্বাসিত জঙ্গি, আটক, বিচারাধীন ব্যক্তি যে কেউ চাইলে হিজবুল মুজাহিদিন ও পাকিস্তানের এই প্রক্সি-ওয়ারের বিরুদ্ধে লড়তে আমাদের সঙ্গে যোগ দিতে পারে।’ এতে মনে হতে পারে, কাশ্মিরের যুদ্ধ আরোপিত, এতে কাশ্মিরি জনগণের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। কিন্তু বাস্তবতা কি তাই? হায়দার-এ ভারত সরকার কাশ্মিরে নির্বাচন ঘোষণা করার পর সংবাদ সম্মেলন করে সেনাবাহিনী। সেখানে এক সাংবাদিক সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তার কাছে বন্দিদের নির্যাতনের বিষয়ে জানতে চাইলে ওই কর্মকর্তা দাবি করেন, ভারতীয় সেনাবাহিনী নির্যাতন করে না, শুধু জিজ্ঞাসাবাদ করে। তাছাড়া কাশ্মিরের বিচ্ছিন্নতাবাদীরা ভারত থেকে স্বাধীনতা নয়, পাকিস্তানের গোলামি করতে চায় বলে দাবি করেন তিনি।

এর কিছু পরে রুহের বর্ণনায় এই জিজ্ঞাসাবাদের নমুনা কতো ভয়ঙ্কর তা দেখানো হয়। সেখানে জিজ্ঞাসাবাদের নামে এক ‘জঙ্গি’’র লিঙ্গ কেটে নেওয়া হয়। কিন্তু এর আগে ওই জঙ্গির অপরাধ কী তাও বলে দেন ‘‘জিজ্ঞাসাবাদ’’কারী কর্মকর্তা¾‘বিস মাসুম বাচ্চে মারে গায়ে তুমহারে ব্লাস্ট মে। তেরে কোই বাচ্চা-কাচ্চা হ্যায় কিয়া? নেহি? আব হোগা ভি নেহি।’ [তোদের বোমা বিস্ফোরণে ২০ শিশু নিহত হয়েছে। তোর কোনো বাচ্চা-কাচ্চা আছে? নেই? আর হবেও না।]

এখন, এক জঙ্গির লিঙ্গ কেটে নিয়ে তারা দাবি করে, বন্দিশিবিরে জিজ্ঞাসাবাদ ছাড়া আর কিছুই করা হয় না, বিষয়টি কেমন হয়ে গেলো না! অবশ্য বোমা মেরে ২০ শিশুকে হত্যা করা জঙ্গির ক্ষেত্রে কী হবে সেটা তো আর বলেনি! সেজন্যই প্রথমে শুধু জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় বলা হলেও, পরে লিঙ্গ কেটে নেওয়া দেখানো হয়¾এতে এটা বুঝতে কষ্ট হয় না যে তাদের কাছে দুটো পরিস্থিতি আলাদা বিষয়। অপরাধের ভিন্নতা আছে এবং সেই অনুযায়ী বিচার ছাড়াই শাস্তি দেওয়ার অধিকারও ভারতীয় সেনাদের আছে! তার মানে অপরাধের মাত্রা বাড়লে কোনো বিচার ছাড়াই হত্যা করার অধিকারও তারা রাখে। যেটা তারা নিয়মিত করছেও। কিন্তু যে প্রশ্নটা উঠে আসে না সেটা হলো, কী কারণে, কোন পরিস্থিতিতে একজন কাশ্মিরি আরেক কাশ্মিরি শিশুর প্রাণ নিতে বোমা মারে কিংবা জঙ্গি হয়। বিপরীতে কেবল বোমা মেরে হত্যাটাই দেখানো হয়।

হত্যায় সম্পৃক্ত কোনো জঙ্গিকে হত্যা করলে যে তা বিচারের আওতায় আসবে না, তার প্রমাণও রয়েছে। ২০১০ খ্রিস্টাব্দে নির্দোষ তিন কাশ্মিরিকে হত্যার দায়ে ২০১৪-তে ভারতীয় আদালত সাত সেনা সদস্যকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন।১৮ এই রায়কে উল্টোভাবে দেখলে যা দাঁড়ায় তা হলো, ওই কাশ্মিরিরা যদি ‘দোষী’ হতো তাহলে নিশ্চয়ই এ হত্যার কোনো বিচার হতো না। এ ধরনের সন্দেহের আরো কারণ আছে, ২০১০-এর এই হত্যাকাণ্ডের পর ভারত সরকার কিন্তু খুব সহজে এই বিচার কাজ শুরু করেনি। এই বিচারের জন্য কাশ্মিরের সাধারণ মানুষকে রাস্তায় নামতে হয়েছিলো। এছাড়া যে আট হাজার কাশ্মিরি গুম হয়েছে তাদের নিয়ে সরকারিভাবে টু শব্দটিও হয় না কোথাও! হায়দারও কিন্তু এসব প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে যায়।

ডিজলভে দাঙ্গা

মিলখা দৌড়াচ্ছেন। পিছন থেকে তার কোচের চিৎকার¾‘‘মিলখা ভাগ, ভাগ।’’ এই চিৎকার শুনে মিলখার চোখে ভেসে ওঠে দেশভাগের সময় তার বাবার চিৎকার, তাকে পালাতে বলার ঘটনা। ডিজলভে দৌড়ের ট্র্যাক পরিণত হয় মিলখার গ্রামের বাড়ির মেঠো পথে, যে পথে তিনি দৌড়ে পালাচ্ছিলেন। আর তার পিছনে খোলা তলোয়ার হাতে কালো ঘোড়ায় চেপে কেউ একজন আসছে। মিলখার বাবা চিৎকার করে বলছেন, ভাগ মিলখা, ভাগ। সেই হত্যাকারীকে দেখতে মিলখা পিছন ফিরে তাকান। হত্যাকারী তলোয়ার চালায়, রক্ত ছিটকে পড়ে। ডিজলভে আবার দৌড়ের ট্র্যাক, পিছনের খেলোয়াড়দের দিকে তাকাতে দেখা যায় মিলখাকে, পিছিয়ে পড়েন তিনি। হেরে যান মিলখা, সঙ্গে ভারতও। বাস্তবে কিন্তু ‘অলিম্পিকের ট্র্যাকে মিলখার কোচ ‘ভাগ মিলখা’ বলে চিৎকার করেননি আর মিলখাও পিছন ফিরে তাকাননি।’১৯

মিলখার বক্তব্য ছিলো, তিনি অমনোযোগী হয়ে পড়ায় প্রতিযোগিতা থেকে ছিটকে পড়েন। তাহলে নির্মাতা দেশভাগের স্মৃতি দেখিয়ে মিলখার হারের জন্য পরোক্ষভাবে পাকিস্তানের মুসলিমদেরই দায়ী করলেন? কিন্তু এমন তো না যে দাঙ্গায় শুধু হিন্দু-শিখরাই হত্যা, নির্যাতনের শিকার হয়েছে। বরং পাকিস্তানে যেমন হিন্দুরা, ভারতে তেমনই মুসলমানরাও একই পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে গেছে সেসময়। অথচ ৪৭-এর দেশভাগের দাঙ্গার চিত্র তুলে ধরতে গিয়ে ভাগ মিলখা ভাগ শুধু পাকিস্তান থেকে ভারতে আসা মানুষদেরই দেখিয়েছে। যেনো পাকিস্তানে কেউ অভিগমন করেনি! যদিও চলচ্চিত্রটি মিলখার জীবন নিয়ে, সেজন্য হয়তো ভারত থেকে পাকিস্তানে অভিগমন সেখানে আসেনি। কিন্তু মিলখার জাতীয় পর্যায়ের কোচ, সেনাবাহিনীতে তার কোচ গুরুদেব সিং এবং ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের সচিব ট্রেনে মিলখার বাড়ি যাওয়ার সময়কার কথোপকথনে ভারত থেকে পাকিস্তান যাওয়ার কোনো কিছু শোনা যায় না। মিলখার পাকিস্তান যেতে সমস্যা কী¾সচিবের এমন প্রশ্নের জবাবে গুরুদেব সিং বলেন,

সেক্রেটারি সাহেব, ১৯৪৭-এ যখন বহু লোক হিন্দুস্তানের স্বাধীনতা উদ্যাপন করছিলো, তখন আরো অনেকে ভাগাভাগির দুর্দশা ভোগ করছিলো। লাখো পরিবার চিরদিনের জন্য গৃহহারা হয়ে যায়। এদের একজন ছিলো মিলখা [ফ্ল্যাশব্যাকে পাকিস্তান থেকে ট্রেনভর্তি মানুষ ভারতে যাচ্ছে, তাদের সঙ্গে মিলখা উদাসভাবে বসে আছে]। ওর পরিবার-পরিজন, গ্রাম ছিলো পাকিস্তানের অংশে। ওর তখন ১০-১২ বছর বয়স। বহু কষ্টে প্রাণ বাঁচিয়ে দিল্লিতে এসে পৌঁছায় সে।

এখানে দেশভাগের দুর্দশা অনেকে ভোগ করেছে বলা হলেও, ভারত-পাকিস্তান দু-দেশেই যে এই দুর্ভোগ সমান ছিলো তা কিন্তু বলা হয় না। বরং পাকিস্তান থেকে ভারতে অভিবাসনই দেখানো হয়। আবার দেশভাগের সময় পাকিস্তান ছাড়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে গ্রামের সবাই যখন একত্র হয়, তখন মিলখার বাবা বলেন¾‘হয় গ্রাম ছেড়ে ভারত চলে যেতে হবে, নয়তো ধর্মান্তরিত হতে হবে, যেমনটা ওরা বলে।’’ এ সময় গ্রামের আরেকজন বলেন, ‘আমরা কখনোই গরুর মাংস খাবো না।’

এই বক্তব্যে এটা স্পষ্ট হয় যে, মুসলমানরা চাপ প্রয়োগ করে তাদের ধর্মান্তরিত হতে বাধ্য করে। আর তা না করলে শিখদেরকে গ্রাম ছাড়তে হবে। একই পরিস্থিতি তো ভারতেও ছিলো, এখনো আছে। ৪৭-এ যেমন তারা মুসলমানদের বাধ্য করেছে দেশত্যাগ করতে, বর্তমানে আইন করে গরুর মাংস খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। শুধু তাই নয়, ‘‘গোমাংস খেতেই হলে পাকিস্তানে যান’২০¾এমন কথাও বলেছেন এক মন্ত্রী। তাহলে ভাগ মিলখা ভাগ-এ একপেশে বক্তব্য কেনো? তাছাড়া শুধু দেশভাগের সময়েই নয়, স্বাধীন ভারতেও অনেক বার হিন্দু-মুসলিম, হিন্দু-শিখ দাঙ্গা হয়েছে। এমনকি ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধেও দাঙ্গায় মদদ দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। ২০০২ খ্রিস্টাব্দের সেই হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্ত মুসলিমরা আজও দুর্দশা ভোগ করছেন।২১ গত ২০১৪’র মে থেকে ২০১৫’’র মার্চ পর্যন্ত দেশটিতে মুসলিম ও খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের ওপর ছয়শোটি হামলার ঘটনা ঘটেছে।২২ শুধু তাই নয়, ভারতে বর্তমানে হিন্দু সন্ত্রাসবাদও প্রসার লাভ করছে, যাদের স্লোগান হচ্ছে¾‘‘পেহেলে কাসাই (মুসলমান), ফির ইসায়ি’ অর্থাৎ, প্রথমে মুসলমানদের শেষ করো, পরে খ্রিস্টানদের।২৩ তাহলে এই পরিস্থিতিতে সেই ৪৭-এর দাঙ্গাকে সামনে এনে ভারতের মুসলিম নিধনকে জায়েজ করতে চান নির্মাতা?

জাতীয় পুরস্কার, জাতীয়তাবাদের পুরস্কার

প্রতিবছর বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ‘ভালো ভালো’ চলচ্চিত্রকে জাতীয় পুরস্কার দেওয়া হয়। সাধারণত দেশের শিল্প-সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, সাধারণ মানুষের যাপিত জীবনের উপস্থাপনসহ বিভিন্ন দিক বিবেচনায় এ পুরস্কারগুলো বণ্টন করা হয়। ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রদানের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের সংস্কৃতিকে বুঝতে সামাজিকভাবে প্রাসঙ্গিক চলচ্চিত্র, যেগুলো আবার রাষ্ট্রীয় ঐক্য ও অখণ্ডতা রক্ষা করবে সেগুলোকেই এ পুরস্কার দেওয়া হয়। পুরস্কার দেওয়ার এই ধারাবাহিকতায় ২০১০ খ্রিস্টাব্দে লাহোর নামের একটি চলচ্চিত্রকে নির্মাতার অভিষেক চলচ্চিত্র ক্যাটাগরিতে জাতীয় পুরস্কার দেয় ভারত।২৪ চলচ্চিত্রের কাহিনি গড়ে উঠেছে এক আন্তর্জাতিক কিকবক্সিং প্রতিযোগিতায় ভারত ও পাকিস্তানের দুই খেলোয়াড়ের প্রতিদ্বন্দ্বিতা নিয়ে। প্রতিযোগিতায় বক্সিং রিঙে পাকিস্তানি বক্সারের হাতে মারা যায় ভারতীয় বক্সার। এর পর সেই পাকিস্তানি বক্সারকে হত্যা করে প্রতিশোধ নিতে চায় ভারতীয় বক্সারের ভাই। শেষ পর্যন্ত তাকে ক্ষমা করে দিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে ভারতীয় ব্যক্তিটি।

একই বছর বলিউডে আরেক নির্মাতার অভিষেক হয় পিপলি লাইভ দিয়ে। এই চলচ্চিত্রের গল্প দেনার দায়ে এক কৃষকের আত্মহত্যা করতে চাওয়ার ঘটনায় গণমাধ্যমের বাড়াবাড়ি নিয়ে। কৃষকের আত্মহত্যা ভারতের জন্য কল্পকথা নয়, নির্মম বাস্তবতা। দেশটিতে প্রতি ৩০ মিনিটে একজন করে কৃষক আত্মহত্যা করেন।২৫ এভাবে ফি বছর হাজারো কৃষক প্রাণ দেন দেনার দায়ে। সেদিক থেকে পিপলি লাইভ বাস্তবতাকে কাছ থেকে দেখা চলচ্চিত্র, যেটি আবার ভারতীয় সামাজিক প্রেক্ষাপটেও গুরুত্বপূর্ণ। চলচ্চিত্রটি নিয়ে সেসময় বেশ আলোচনাও হয়। অথচ পিপলি লাইভ কিন্তু পুরস্কার পায়নি, পেয়েছে ভয়ঙ্করভাবে জাতীয়তাবাদে দুষ্ট লাহোর। পাকিস্তানকে হেয় করার অভিযোগে সেদেশে নিষিদ্ধ পর্যন্ত করা হয় লাহোরকে।

আর নিষিদ্ধের সেই ধারাবাহিকতায় হায়দারও পাকিস্তানে আলোর মুখ দেখেনি। পাকিস্তানের চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ড কাশ্মিরের মতো বিতর্কিত ইস্যু নিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্রকে ছাড়পত্র দেয়নি।২৬ যদিও সেনাক্যাম্পে নির্যাতনের দৃশ্য দেখিয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে অপমান করা হয়েছে দাবি করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেক ভারতীয় চলচ্চিত্রটির সমালোচনা করেন। তারা হয়তো বন্দিশিবিরে নির্যাতন এবং সেনাবাহিনীর হাতে গুমের মতো ঘটনাকে স্বাভাবিক বলেই মনে করেন। কারণ, দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকি মোকাবেলা করাই তো সেনাবাহিনীর কাজ। আর তা সুষ্ঠুভাবে করার জন্য সেনাবাহিনী ‘‘যা দরকার’ তা-ই করতে পারে। তার মানে ভারতীয় জনগণও জানে কাশ্মিরে যা হচ্ছে তা ‘পাকিস্তান করাচ্ছে’! তাই এসব পাকিস্তানি ‘দালালদের’ প্রতি সহানুভূতি দেখানোর কোনো সুযোগ নেই বলেই হয়তো তারা টুইটারে ‘#boycotthaider’ কর্মসূচি পালন করে। তবে ৬২তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের আসরে পাঁচটি ক্যাটাগরিতে চলচ্চিত্রটির পুরস্কার প্রাপ্তি কিন্তু ভিন্ন কথাই বলে। সাধারণ দর্শক ধরতে না পারলেও জুরি বোর্ড চলচ্চিত্রটির মাজেজা ঠিকই ধরতে পেরেছেন¾হায়দার সেনাবাহিনীর কাজকে প্রশ্নবিদ্ধ নয়, বরং নৈতিক অনুমোদন এনে দিয়েছে। পাকিস্তানকে ভারতের শত্রু প্রমাণে সফল হয়েছে।

অন্যদিকে নিষিদ্ধতার একই চিত্র ফিল্মিস্তান-এর ক্ষেত্রেও দৃশ্যমান হয়। পাকিস্তানি সেন্সর বোর্ড এই চলচ্চিত্রকেও সেদেশে প্রদর্শনের অনুমতি দেয়নি।২৭ কারণ সেই আগেরটাই¾পাকিস্তানকে হেয় করা হয়েছে। সেখানে পাকিস্তানকে যেভাবে শিল্প-সাহিত্যে অনগ্রসর ও প্রতিক্রিয়াশীল হিসেবে দেখানো হয়েছে তা আগেই বলা হয়েছে। আর অন্যসব বিতর্কিত চলচ্চিত্রের মতো এটিও কিন্তু জাতীয় পুরস্কার পেয়েছে। ফিল্মিস্তান ২০১৪’’র হিন্দি ভাষার শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হিসেবে জাতীয় পুরস্কার পায়।

এবার আসি ভাগ মিলখা ভাগ-এ। মিলখা প্রীতি ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পাকিস্তান না যেতে চেয়ে বলেন, ‘আমি পারবো না। আমি পাকিস্তান যাবো না।’ এই সংলাপকে অসম্মানজনক দাবি করেছে পাকিস্তান। সেজন্য দেশটি এই চলচ্চিত্রকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।২৮ আর বরাবরের মতো ভারতে এই চলচ্চিত্রটিও জাতীয় পুরস্কার পায়। ২০১৩’’র সেরা বিনোদনমূলক চলচ্চিত্র ও কোরিওগ্রাফি¾দুই শাখায় জাতীয় পুরস্কার পায় এটি। লাহোর থেকে ভাগ মিলখা ভাগ, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রাপ্ত চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে শুধু একটি বিষয়ই সাধারণ, ‘‘পাকিস্তান বিরোধিতা’।

আগেই বলেছি, ঐক্য ও অখণ্ডতা রক্ষা করে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের সংস্কৃতিকে ফুটিয়ে তোলা চলচ্চিত্রগুলোকেই জাতীয় পুরস্কার দেওয়া হয়। আর এই ঐক্য ও অখণ্ডতার ভিত্তিতেই রাষ্ট্রের জাতীয়তা নির্ধারণ হয়। তাহলে পাকিস্তান বিরোধিতা কি ভারতের জাতীয় বৈশিষ্ট্য, যে বৈশিষ্ট্য ধারণের পুরস্কার এই চলচ্চিত্রগুলো পেয়েছে?

নামে অনেক কিছু আসে-যায়’

নামকরণের গোড়ার ইতিহাস যাই থাকুক না কেনো, চলতি ব্যাখ্যায় হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের আধিক্যের কারণেই ভারতের অপর নাম হিন্দুস্তান। নির্দিষ্ট করে বললে হিন্দুস্তান শব্দের অর্থ দাঁড়ায় হিন্দুদের স্থান বা আবাসভূমি।২৯ মুসলিমপ্রধান এলাকার বিপরীতে হিন্দুপ্রধান এলাকার এই নামকরণ হয়তো যুক্তিযুক্তও। এই হিসেবে ‘‘ফিল্মিস্তান’ শব্দের অর্থ হয় ফিল্ম বা চলচ্চিত্রের আবাসভূমি, এক কথায় ‘‘চলচ্চিত্রভূমি’’। তার মানেটা দাঁড়ায়, ফিল্মিস্তান এমন এক স্থান বা রাষ্ট্রের কথা বলে যেখানে চলচ্চিত্রই আধিপত্যশীল। চলচ্চিত্রেও অবশ্য তেমনটাই দেখা যায়। ভারতীয় সানি কিংবা পাকিস্তানি আফতাব, তার গ্রামের লোকেরা¾সবাই চলচ্চিত্রের প্রতি আসক্ত। সানি যেমন চলচ্চিত্র তারকা হতে চায়, আফতাব তেমনই হতে চায় নির্মাতা। অন্যদিকে পাকিস্তানের লোকজনকে দেখা যায় চলচ্চিত্রের একনিষ্ঠ দর্শক হিসেবে। কিন্তু সমস্যা একটাই, এই ‘‘চলচ্চিত্রভূমি’র সব চলচ্চিত্রই ভারতীয়!

পাকিস্তানি আফতাব চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে চায়, তবে সেটা বলিউডের অনুকরণে। এমনকি তার নির্মাতা হতে চাওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে, বলিউডের মতো ললিউডে চলচ্চিত্র নির্মাণ না হওয়ার অভাব পূরণ করা। শুধু তাই নয়, তাদের কাছে ভারতীয় তারকারাই যে মূল আকর্ষণের জায়গা তাও ফুটে ওঠে আফতাবের বয়ানে। সে সানিকে বলে, ‘‘আমার বাবা তো ইউসুফ ভাইয়ের (দিলিপ কুমার) খুবই ভক্ত। ভক্ত কী, একেবারে মুরিদ! ... ভারতের সঙ্গে যতো ঝামেলাই থাকুক, চলচ্চিত্র কিন্তু আমরা ওই দেশেরই দেখি।’ তার মানেটা দাঁড়ায়, ‘‘চলচ্চিত্রভূমি’’টা ভারতের দখলেই রেখে দেন নির্মাতা। এখানেই শেষ করেননি, নির্মাতা তাদের ‘‘চলচ্চিত্রভূমি’’তে আফতাবকে হিজরতও করিয়ে নেন।

হিন্দি ‘‘ভাগ’’ শব্দটির অর্থ পালানো, দৌড়ানো কিংবা দৌড়ে পালানো। তাহলে ‘‘ভাগ মিলখা ভাগ’’ অর্থ দাঁড়ায়, ‘‘পালাও মিলখা পালাও’’ কিংবা ‘‘দৌড়াও মিলখা দৌড়াও’। কিন্তু মিলখা কোথায় পালাবে, কার কাছে পালাবে, কার কাছ থেকে পালাবে? কিংবা মিলখা কোথায় দৌড়াবে, কার বিরুদ্ধে দৌড়াবে, কেনো দৌড়াবে? ভাগ মিলখা ভাগ শুরু হয় অলিম্পিকের ট্র্যাকে মিলখার দৌড়ানোর দৃশ্য দিয়ে, যেখানে তার কোচ চিৎকার করে বলতে থাকেন, ‘‘মিলখা ভাগ, ভাগ!’’ তাহলে কি মিলখাকে চলচ্চিত্রে পালাতে নয়, দৌড়াতে বলা হয়েছে? কিন্তু পরক্ষণেই সেই ধন্ধটা ভেঙে দেন নির্মাতা। কোচের ‘‘মিলখা ভাগ’’ বলার সঙ্গে সঙ্গেই মিলখার স্মৃতিপটে ভেসে ওঠে তার বাবার ‘‘ভাগ মিলখা, ভাগ’’ বলে চিৎকার, আর তলোয়ার হাতে ঘোড়ায় চড়ে একজনের তেড়ে আসার দৃশ্য। বোঝা যায়, দৌড়াতে নয় মিলখাকে চলচ্চিত্রে পালাতেই বলা হয়। কার কাছ থেকে পালাতে বলা হয় মিলখাকে?

চলচ্চিত্রে ‘ভাগ মিলখা, ভাগ’’ শুনলেই মিলখার ৪৭-এর দাঙ্গার কথা মনে পড়ে যায়। যে দাঙ্গায় শুধু এক বোনকে ছাড়া তিনি তার পরিবারের সবাইকে হারিয়েছেন। আর তার বাবা চিৎকার করে পালাতে বলায়, এই দাঙ্গা থেকে বাঁচতে মিলখা পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসেছেন ভারতে। তার মানে দাঁড়ায়, চলচ্চিত্রে মিলখাকে যে পালানোর কথা বলা হয় সেটা পাকিস্তান থেকে। আর পলাতক মিলখার একমাত্র নিরাপদ গন্তব্য হয়ে ওঠে নির্মাতার দেশ ভারত।

পাকিস্তান থেকে পালাতে বলা দিয়ে শুরু হয়ে ভাগ মিলখা ভাগ শেষ হয় সেই পাকিস্তান গিয়েই; তবে এবার ভারতীয় হিসেবে স্বীকৃতি আদায়ের মধ্য দিয়ে। কিন্তু মিলখার জীবনী নিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্রটি এই পর্যায়ে শেষ হলেও, মিলখার ক্যারিয়ার কিন্তু এখানেই শেষ হয়নি। বরং ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে পাকিস্তান সফরের পর, ১৯৬২’’র এশিয়ান গেমসেও তিনি দুটি সোনা জিতেন।৩০ তাহলে এভাবে পাকিস্তান দিয়ে শেষ করার মাজেজা কী?

এবার হায়দার। সেনাবাহিনীর হাতে গুম হন চিকিৎসক হিলাল মির। হায়দার বাবাকে খুঁজতে বের হওয়ার একপর্যায়ে জানতে পারে, তাকে হত্যা করা হয়েছে। হিলালের অপরাধ, তিনি জঙ্গিদের আশ্রয় ও চিকিৎসা দিতেন। আর হিলালকে সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দেয় তারই ছোটো ভাই খুররম। এটা জানতে পেরে হায়দার তার চাচাকে হত্যা করে পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নিতে চায়। যে সেনাবাহিনী তার বাবাকে আটক করে বিনা বিচারে হত্যা করলো, তাদের প্রতি হায়দারের কিন্তু কোনো ক্ষোভ চলচ্চিত্রে দেখা যায় না। বরং গুম হওয়ার ঘটনায় সেই রাষ্ট্রেরই দ্বারস্থ হয় সে, থানায় যায় জি ডি করতে। বলছি না, আইন না মেনে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে একাই বন্দুক হাতে হায়দারের নেমে পড়া উচিত ছিলো। পরে অবশ্য হায়দার অস্ত্র ঠিকই তুলে নেয়, তবে চাচাকে হত্যা করতে। তার মানে, প্রতিশোধস্পৃহা তার ছিলো। তবে গুম-খুনের মতো রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে নয়, চাচার বিরুদ্ধে, যিনি এই ধরনের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের হোতা নন, সহযোগী মাত্র। বিষয়টা অনেকটা এমন¾অস্ত্র যে চালায় তাকে নয়, বরং অস্ত্রকেই আগে ধ্বংস করতে চাইলো হায়দার। যেনো অস্ত্র ধ্বংস করলে, অস্ত্রধারীও শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু বাস্তবে অস্ত্রধারীরা নতুন নতুন অস্ত্র বানায়।

তাই যে হায়দার কাশ্মিরে চলমান জুলুম-নির্যাতনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ঝাণ্ডা ধরতে পারতো, নির্মাতা তার হাতে রাষ্ট্রের সঙ্গে সমঝোতার সাদা ঝাণ্ডাই ধরিয়ে দিলেন। কাশ্মিরে যে আট হাজার মানুষ গুম হয়েছে তাদের পরিজনদের সঙ্গে এক কাতারে দাঁড়িয়ে থেকে রাষ্ট্রের কাছে করুণা চায় হায়দার, তাদেরকে সঙ্গে নিয়ে কার্যকর কোনো সমাধানের সন্ধান করতে নামে না। অবশ্য চলচ্চিত্রের একপর্যায়ে সে যখন কাশ্মিরে মুসলমানদের ওপর নির্যাতনের আইনি হাতিয়ার ‘‘আফ্সপা’ (AFSPA¾Armed Forces Special Power Act) নিয়ে প্রশ্ন তোলে তখন পুলিশ চলে আসলে সে গেয়ে ওঠে¾সারে জাহা সে আচ্ছা, হিন্দুস্তান হামারা [সারা দুনিয়ার চেয়ে উত্তম আমাদের ভারত]। কিন্তু বিপ্লবীরা তো রাষ্ট্রীয় রক্তচক্ষুকে ভয় পায় না। ব্রিটিশ ভারতের ক্ষুদিরাম তো আদালতে দাঁড়িয়ে হাসতে হাসতে ফাঁসির রায় কবুল করেছেন, তবু ব্রিটিশ জিন্দাবাদ বলেননি। তাহলে হায়দারের এই উপস্থাপন কি ন্যায়-সমতার বিপরীতে রাষ্ট্রের জুলুম-নির্যাতনের বিজয় ঘোষণা করে না?

কী বুঝলেন?

হায়দার-এ একটি শব্দ একাধিকবার ব্যবহার করেছে হায়দার¾চুজপা। যদিও সে একে হিব্রু শব্দ বলেছে, প্রকৃতপক্ষে ইডিস (Yiddish) ভাষার শব্দটির বর্তমানে প্রচলিত অর্থ লজ্জাহীন স্পর্ধা। কেউ যখন কোনো অন্যায় করার পরও মানুষের সহানুভূতি প্রত্যাশা করে বা ভুলটাকে ঠিক বলে দাবি করে, তখন সেটাকে বলা হয় চুজপা। রাষ্ট্রও সবসময় তার জনগণের সঙ্গে সেই চুজপা-ই করে এসেছে। কারণ রাষ্ট্রের যে চরিত্র সেখানে নৈতিকতার কোনো স্থান নেই।৩১ অথচ সে তার জনগণকে সবসময় নীতি মেনে চলার আহ্বান জানিয়েছে।

‘অনৈতিক রাষ্ট্রে’র সুরে সুর মিলিয়ে আলোচিত তিনটি চলচ্চিত্র জনগণকে সেই ছবকই দিলো। নিজ রাষ্ট্রের ব্যর্থতার খতিয়ান তৈরির চেয়ে রাষ্ট্র হিসেবে তুলনামূলকভাবে ভারত কতো ভালো, যেনো সে হিসাবই নিয়ে বসেছিলেন তিন নির্মাতা। আর সেই হিসাব দেখিয়ে তারাও হয়তো সাধারণ মানুষের সঙ্গে চুজপা-ই করে গেলেন!

লেখক : মাহামুদ সেতু, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী। তিনি হীরকের রাজা ২০১৪ (চাইলে দেখতে পারেন : https://www.youtube.com/watch?v=yeBMbr8WNsE) নামে একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। বর্তমানে তার নতুন স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের প্রি-প্রোডাকশনের কাজ চলছে। 

msetu.mcj@gmail.com

তথ্যসূত্র

১. ‘হিন্দুরা বেশি সন্তান জন্ম না দিলে ভারত হবে মুসলমানদের’’; কালের কণ্ঠ, ০৫ এপ্রিল ২০১৫।

২. পাণ্ডে, জ্ঞানেন্দ্র (১৯৯৮ : ২৭৬); ‘‘ভগ্নাংশের সমর্থনে : দাঙ্গা নিয়ে কী লেখা যায়?’’; নিম্নবর্গের ইতিহাস; সম্পাদনা : গৌতম ভদ্র ও পার্থ চট্টোপাধ্যায়; আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লি., কলকাতা।

৩. http://bit.ly/1Jo1pso

৪. প্রাগুক্ত; পাণ্ডে, জ্ঞানেন্দ্র (১৯৯৮ : ২৭৫)।

৫. হোসেন, মাহমুদুল (২০১০ : ১০৯); সিনেমা; ফ্ল্যাট ১/বি, বাড়ি ২৮, সড়ক ১৫ (নতুন), ধানমণ্ডি, ঢাকা-১২০৯।

৬. প্রাগুক্ত; হোসেন, মাহমুদুল (২০১০ : ৭৪)।

৭. প্রাগুক্ত; হোসেন, মাহমুদুল (২০১০ : ৭৩-৭৫)।

৮. বকুল, কাওসার; ‘দ্য রিভার : দৃকমাধ্যমে রেঁনোয়া’র প্রাচ্যনির্মাণ’; ম্যাজিক লণ্ঠন; সম্পাদনা : কাজী মামুন হায়দার; সংখ্যা ৮, বর্ষ ৪, জানুয়ারি ২০১৫, পৃ. ১৪২, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

৯. পারভেজ, রুবেল; ‘‘লাইট, ক্যামেরা, অ্যাকশন : চলচ্চিত্র-ময়দানে যুদ্ধ’’; ম্যাজিক লণ্ঠন; সম্পাদনা : কাজী মামুন হায়দার; সংখ্যা ৬, বর্ষ ৩, জানুয়ারি ২০১৪, পৃ. ২৬, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

১০. মিথ্যাচৈতন্য¾মার্কসিয় মতবাদ অনুসারে পুঁজিবাদী রাষ্ট্র নিম্নবর্গের মানুষকে তাদের প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে জানতে দেয় না। পড়ুন : https://tinyurl.com/5fjhba7n

11. https://tinyurl.com/nhaxezju

12. http://www.poverties.org/poverty-in-india.html

13. https://tinyurl.com/4zvfcf5k

14. http://www.prothom-alo.com/sports/article/162337

15. https://tinyurl.com/ympja2b7

১৬. https://tinyurl.com/27x8249p

১৭. পারভেজ, রুবেল; ‘রানওয়ে : একটি মুসলমানি চলচ্চিত্র’; ম্যাজিক লণ্ঠন; সম্পাদনা : কাজী মামুন হায়দার; বর্ষ ৩, সংখ্যা ১, জুলাই ২০১৩, পৃ. ১৩৫, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

18. https://tinyurl.com/4hnh9ht9

19. http://www.dailypioneer.com/sunday-edition/sunday-pioneer/backpack/no-one-said-bhaag-milkha-bhaag.html

20. http://bit.ly/1RbqwA2

21. https://tinyurl.com/3s2d9tdj

22. https://tinyurl.com/9cym82md

23. https://tinyurl.com/4whbnuz8

24. http://en.wikipedia.org/wiki/Lahore_%28film%29

25. https://tinyurl.com/5n7mduz3

26. http://tribune.com.pk/story/775291/the-haider-cauldron-in-pakistan/

27. N/A

28. N/A

29. http://www.thefreedictionary.com/Hindustan

30. https://tinyurl.com/yc8b9ahm

৩১. নিউটন, সেলিম রেজা (২০১৩ : ৮৪); নয়া মানবতাবাদ ও নৈরাজ্য : এম. এন. রায়ের মুক্তিপরায়ণতা প্রসঙ্গে; আগামী প্রকাশনী, ঢাকা।


বি. দ্র. প্রবন্ধটি ২০১৫ সালের জুলাই মাসে প্রকাশিত ম্যাজিক লণ্ঠনের ৯ম সংখ্যায় প্রথম প্রকাশ হয়।



এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন